>

ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়





সংশপ্তক:   অধিকাংশ বাঙালিরই রবীন্দ্রনাথের সাথে প্রথম পরিচয় সহজ পাঠের পাতায়! তারপর সেই পরিচয়ের সূত্র ধরে তাঁর সাথে প্রথম আলাপ যার যার নিজস্ব পরিসরে এক এক রকম ভাবে গড়ে ওঠেআপনার ক্ষেত্রে সেই প্রথম আলাপ গড়ে ওঠার গল্পটা যদি একটু বলেন আমাদের।:
ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়:  রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর ছ’মাস পরে আমার জন্ম । তখনও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়নি । ভয়ঙ্কর দারিদ্র, পরের বছর তেতাল্লিশের মন্বন্তর, কলকাতার রাস্তায় ভুখা মানুষের মৃত্যু মিছিল । “জন্মেই দেখি ক্ষুব্ধ স্বদেশ ভুমি”সাত কি আট বছর বয়সটাই সহজ পাঠের সঙ্গে পরিচয়ের বয়স । আমার ক্ষেত্রে সেই সময়টা ১৯৪৯ কি পঞ্চাশ শাল । দেশ সবে স্বাধীন হয়েছে । পুনর্গঠনের কাজ প্রায় শুরুই হয়নি । ‘ইয়ে আজাদি ঝুটা হায়, ভুলো মাৎ ভুলো মাৎ’ আমার সেই শৈশবকে বেশ নাড়া দিয়েছিল । মিটিং, মিছিল, দাঙ্গার আবহ, উদবাস্তুর স্রোত - সেই সামাজিক সময়টা মোটেই সুস্থিত ছিল না । আমার পরিবারের মত নিম্নবিত্ত সংসারে রবীন্দ্রনাথ তখন মনে রাখার মত আদরের মানুষ ছিলেন না মোটেই । সহজ পাঠ তখন স্কুলের পাঠ্য তালিকায় ছিল নাকিন্তু সেই শৈশবে এটা জেনেছিলাম, রবীন্দ্রনাথ নামের ঐ সাড়ে পাঁচ অক্ষরের নামটা বাঙালির আর এক ঠাকুর, কবিতার ঠাকুর তারপর দশ-এগারো বছর বয়সে, কি করে জানি না কবিতার আবৃত্তি করার প্রবল আগ্রহ জন্মেছিল । পাড়ায় চৌকি পেতে, মা দিদিদের শাড়ি দিয়ে স্টেজ বানিয়ে দাদারা জলসা করতো আমি সুযোগ পেতাম আবৃত্তি করার । আর সেই সব জলসায় আবৃত্তি মানেই রবিঠাকুরের সঞ্চয়িতার কবিতা । আমার শৈশবে অতয়েব সঞ্চয়িতার রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে প্রথম পরিচয়। আমাদের গোটা জীবন জুড়ে রবীন্দ্রনাথের অমোঘ আগ্রাসী প্রভাবের আভাষ এক দশ বছরের বালকের পাবার কথা নয়, আমিও পাইনি ।

সংশপ্তক:   একটু গভীর ভাবে দেখলে আমরা দেখতে পাই, আমাদের যার যার জীবনে শৈশবের রবীন্দ্রনাথ কৈশরের রবীন্দ্রনাথ যৌবনের রবীন্দ্রনাথ আসলেই ক্রমশ প্রকাশ্য রবীন্দ্রনাথের একটা ধারাবাহিক পর্বই! আমরা যার জন্যে ঠিক প্রস্তুত থাকি না, অথচ এই ধারাবাহিক ভাবেই কবি যেন আমাদেরকেই প্রস্তুত করে তোলেন আমাদের জীবনের পূর্ণ উদ্বোধনের জন্যেই! আপনার ব্যক্তি জীবনের গড়ে ওঠার পর্বে রবীন্দ্রনাথ কিভাবে প্রভাব বিস্তার করেছিলেন সেই গল্পটা যদি বলেন
ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়:  খুব সঠিকভাবেই বলেছো আমাদের যার যার জীবনে শৈশবের রবীন্দ্রনাথ, কৈশোরের রবীন্দ্রনাথ আর যৌবনের রবীন্দ্রনাথ আসলেই ক্রমশ প্রকাশ্য রবীন্দ্রনাথের একটা ধারাবাহিক পর্ব । এবং এটাও ঠিক যে আমরা প্রস্তুত থাকি না বটে, কিন্তু রবীন্দ্রনাথই আমাদের প্রস্তুত করে তোলেন । তিনি আবিস্কৃত হন, উন্মোচিত হন  নব নব রূপে । সঞ্চয়িতার রবীন্দ্রনাথ আর ১৯৩০ পরবর্তী রবীন্দ্রনাথ তো এক নয় । আমার কৈশোরকাল থেকেই সেই ‘অন্য রবীন্দ্রনাথ’এর অন্বেষণ ।
আমার কৈশোর মানে মধ্যপঞ্চাশ - ১৯৫৫-৫৬’র সময়কাল । বলে রাখা যাক, কৈশোরকাল থেকেই মার্কসবাদী জীবনদর্শন আমাকে প্রভাবিত করেছিল এবং সেই জীবনবোধই যে আমার বাকি জীবনকে নিয়ন্ত্রিত করবে তাতে সংশয় ছিল নাআমার কৈশোর – যৌবনের তাবৎ রবীন্দ্র-অন্বেষণ, রবীন্দ্রনাথকে জানার চেষ্টা অতয়েব সেই জীবন-দর্শনের আলোকে । কৈশোর-যৌবনের সন্ধিলগ্নে কোন এক রবীন্দ্র জয়ন্তীর আসরে শোনা একটা কবিতা আমাকে দারুণ প্রভাবিত করেছিল, আজও মনে আছে । ‘প্রান্তিক’ কাব্য-গ্রন্থের ‘নবজাতক’ কবিতাটি ... প্রায় একই সময়ে লেখা ‘আফ্রিকা’ কবিতাটির কথাও বলবো । বস্তুত আমার কৈশোরে শোনা এই দুটি কবিতা শেষ দশ বছরের রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে আমার আলাপের প্রথম সংকেত । তারপর কৈশোর যৌবন পেরিয়ে প্রৌঢ়ত্বের সীমা পর্যন্ত সেই রবীন্দ্রনাথেরই অন্বেষণ ।
গত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকে সদ্যস্বাধীন দেশের প্রথম প্রজন্ম আমরা - যারা এক নতুন সমাজ বন্দোবস্তের স্বপ্ন লালন করা শুরু করেছিলাম, তাদের সেই ভাবনায় রবীন্দ্রনাথ ছিলেন অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক । ভবিষ্যৎ সমাজের কোন সুস্পষ্ট স্বীকৃতি তিনি দেননি বটে কিন্তু যে আত্মশক্তির উদবোধন তাঁর আবিচল লক্ষ্য ছিল তার মূল্য অপরিসীম  । ভয়শূন্য চিত্তের যে আদর্শ  তিনি আমাদের লালন করতে বলেছেন তা ভুলবো কি করে ?
জীবনের শেষ দশ বছরের রবীন্দ্রনাথের কথা বলছিলাম । ১৯৩০ পরবর্তী বিশ্ব সাক্ষী থেকেছিল এক তোলপাড় সময়ের । ১৯৩০এ জার্মানিতে হিটলারের ক্ষমতা দখল ও চেতনাধ্বংশী ফ্যাসিবাদের উত্থান এবং দ্বিতীয় সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ ১৯৩৯এ । ১৯৪৫এ ফ্যাসিবাদের চূড়ান্ত পরাজয়ের সঙ্গে যুদ্ধের অবসান । ১৯৩০ পরবর্তী এই পনেরো বছরের দ্রুত প্রবহমান ঘটনার প্রথমার্ধেই রবীন্দ্রনাথের জীবনাবসান হয় । যুদ্ধের ভয়াবহতা এবং তার করুণ পরিণতি তিনি দেখে যাননি ঠিকই কিন্তু তাঁর সংবেদনশীল মন অনেক দূর পর্যন্ত দেখতে পেয়েছিল । এবং একথাও তিনি উচ্চারণ করেছিলেন যে উন্মত্ত দানবিকতার দাপট একদিন নিরস্ত হবে আর শুভবুদ্ধির নির্মল আকাশে মানুষ চোখ মেলবে ।
যুদ্ধ শুরু হয় ১৯৩৯এ কিন্তু বিপর্যয়ের কালো মেঘ জমতে শুরু করে হিটলারের ক্ষমতা দখলের পর থেকেই । ১৯৩০ পরবর্তী সমস্ত বিশ্ব-ঘটনাই লক্ষ্য করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ এবং মানবতার সম্ভাব্য বিপর্যয়ের আশঙ্কা ব্যক্ত করেছিলেন ১৯৩৩এ লেখা ‘কালান্তর’ প্রবন্ধে । বস্তুত, এ দেশে ফ্যাসিবাদ বিরোধী সংগ্রামে রবীন্দ্রনাথের ভুমিকাই ছিল অগ্রণী ও পথিকৃতের । ১৯৩০এর পর সৌন্দর্য ও কল্পনার জগত থেকে সরে এসে সেই সময়ের বাস্তবের মুখোমুখি দাড়ালেন । ভগ্ন শরীর নিয়ে ১৯৩০এ সমাজতান্ত্রিক রাশিয়া ভ্রমণ করলেন বুঝতে চাইলেন রাষ্ট্রযন্ত্র মানব কল্যানে কি কার্যকর ভুমিকা নিতে পারে । ঐ বছরেই শেষবার জার্মানি ভ্রমণে বুঝেছিলেন ওখানে ফ্যাসিবাদের উত্থানের ভিত্তিভুমি তৈরি হয়ে গেছে আর তারপর নাৎসি বাহিনী যখন চল্লিস হাজার বইএর বহ্নুৎসব করেছিল রাজপথে, তখন রবীন্দ্রনাথের বইও বাদ যায়নি । ১৯৩৬এ ফ্যাসিস্ট ইতালী আবিসিনিয়া আক্রমণ করার পর ব্যথিত সংবেদনশীল কবি লিখেছিলেন ‘আফ্রিকা’ এবং এক স্কুল ছাত্র অটোগ্রাফ দিয়ে ১৯৩৭এ লেখেন
‘বিদায় নেবার আগে তাই ডাক দিয়ে যাই,
দানবের সাথে যারা সংগ্রামের তরে
প্রস্তুত হতেছে ঘরে ঘরে’ এই পংক্তিকটি ‘প্রান্তিক’ কাব্যগ্রন্থের একটি কবিতার শেষে জুড়ে দিয়েছেন ‘নাগিনীরা চারিদিকে ফেলিতেছে বিষাক্ত নিঃশ্বাস,
শান্তির ললিত বাণী শুনাইবে ব্যর্থ পরিহাস –
বিদায় নেবার আগে তাই ...... প্রস্তুত হতেছে ঘরে ঘরে’ যা  হয়ে উঠেছিল এদেশে আন্তর্জাতিক ফ্যাসিবাদ ও তাবৎ উৎপীড়ণ বিরোধী সংগ্রামের চারণ-মন্ত্র । স্বাধীনতা-উত্তর প্রথম প্রজন্মের প্রতিনিধি আমার ব্যক্তিজীবন গড়ে ওঠায় শেষ দশ বছরের রবীন্দ্রনাথের অবিসংবাদী প্রভাব ছিল,  কৈশোর-যৌবনে সেই রবীন্দ্রনাথেরই অন্বেষণ করে গিয়েছি । এবং এখনও ।

সংশপ্তক:    রবীন্দ্র-প্রতিভার ঠিক কোন দিকটি, আপনার যৌবনের পর্বে বেশি মাত্রায় আন্দোলিত করেছিল আপনাকে?
ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়:  আমি যেমন স্বাধীনতা-উত্তর কালের প্রথম প্রজন্মের প্রতিনিধি তেমনই রবীন্দ্র-উত্তর কালের প্রথম প্রজন্মও বটে । আমার পরম সৌভাগ্য যে ১৯৬১তে  রবীন্দ্রনাথ যখন শতবর্ষে পা দিলেন আমি তখন ১৯ বছরের তরুণবিশ্বকে নতুন ভাবে দেখতে শিখছি । শতবর্ষে রবীন্দ্রনাথকে ঘিরে বাংলার সাংস্কৃতিক জগতের যে উচ্ছাস, নানান ক্ষেত্রে যে বিপুল আয়োজন, সাহিত্য, নাটক, চলচ্চিত্র সহ নানান ক্ষেত্রের রবীন্দ্র-প্রতিভার নব নব উন্মোচন আর নব নব রবীন্দ্রনাথের আবিস্কার থেকে সঞ্চয় করেছি বাকি জীবনের ঐশ্বর্য ।
নিজেকে নাটকের লোক বলতে আমার ভালো লাগে । সেই কৈশোর থেকে এই বার্ধক্যের সীমায় এসেও নাটকের সঙ্গে আমার নিবিড় সংস্পর্শ এখনও । এবং যার শুরুটা রবীন্দ্রনাথ’এঅনেকের মত বালক বয়সের ‘মুকুট’ মঞ্চায়ন নিশ্চই বলার মত কিছু নয় । তারপর ‘রথের রসি’, ‘অচলায়তন’ বা ‘ডাকঘর’ যখন করেছি কৈশোরে তখন সেগুলির ভাবার্থ বা সে নাটকের বার্তা সেই বয়সে আমার কাছে পরিস্কার হওয়ার কথা নয়, হয়ওনি । পরে ১৯৬১তে চমকে উঠেছিলাম ‘রক্তকরবী’র প্রযোজনা দেখে । চমকটা নিশ্চিত ভাবেই ছিল সে নাটকের মঞ্চস্থাপত্য, অভিনয় ও আলোর জাদুর জন্য, কিন্তু ‘রক্তকরবী’ই প্রথম আমাকে নাটকের ভেতরে ঢুকতে শেখালো । তারপর সেই যৌবন থেকে বার্ধক্যে পৌঁছেও নাটকের রবীন্দ্রনাথকে বুঝতে চাইছি আমার মত করে
রবীন্দ্র নাট্যভাবনার সারাৎসার- জড়শক্তির সঙ্গে প্রাণশক্তির বিরোধ, পরিণামে প্রাণশক্তির জয়লাভ । তাঁর নাট্য রচনায় তাৎক্ষণিক বাস্তবের ছায়াপাত অনুপস্থিত সত্য । কিন্তু বন্ধন ও মুক্তির যে দ্বন্দ্ব তাঁর নাটকে পাই তা আবহমান কালের । তাৎক্ষণিকতায় আবদ্ধ নয় । ‘রক্তকরবী’ নাটকে ধনবাদী সভ্যতা আর সংকট থেকে মুক্তির রূপক, ‘মুক্তধারা’ নাটকে রাজার বিরুদ্ধে কৃষিজীবি প্রজাদের বিদ্রোহ, ‘বিসর্জন’এ ছদ্ম অহংকার ও সংস্কারাচ্ছন্ন  দম্ভ ও প্রতিপত্তির বিপ্রতীপে মানবিকতার জয়বার্তা, ‘রথের রসি’তে সম্মিলিত শূদ্রশক্তির জয়গাথা, ‘অচলায়তন’এ জীর্ণ সংস্কার আর নিষেধের প্রাচীর ভাঙার আহ্বান ও কালের চালিকাশক্তি রূপে সম্মিলিত শূদ্রশক্তির অভিষেকের অনিবার্যতা দেখেছিলেন । এ সবই তো সমকালেও প্রাসঙ্গিক
‘রক্তকরবী’ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন “ যক্ষপুরে পুরুষের প্রবল শক্তি মাটির তলা থেকে সোনার সম্পদ ছিন্ন করে আনছে । নিষ্ঠুর সংগ্রহের লুব্ধ চেষ্টার তাড়নায় প্রাণের মাধুর্য সেখান থেকে নির্বাসিত , সেখানে জটিলতার জালে আপনাকে আপনি জড়িত করে বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন । তাই সে ভুলেছে সোনার চেয়ে আনন্দের দাম বেশি । প্রতাপের মধ্যে নেই পূর্ণতা নেই, প্রেমেই পূর্ণতা । সেখানে মানুষকে দাস করে রাখার প্রকান্ড আয়োজনে মানুষ নিজেকেই নিজে বন্দী করেছে” ধনবাদী দুনিয়ার স্বরূপ কিংবা আজকের বিশ্বায়নজাত ভোগবাদের সর্বনাশা রূপের এমন সংকেত কি প্রবলভাবে প্রাসঙ্গিক ।  
আমাদের পরিচিত নাট্যিবৃত্ত আমাদের দৈনন্দিন পাওয়া-না পাওয়া,সুখ-দুঃখ, সংগ্রাম ইত্যাদি তাৎক্ষণিক আবেগের মঞ্চভাষ্য নির্মাণ করে, কিন্তু রবীন্দ্রনাট্য এই তাতক্ষণিকতার ঊর্ধে মানবিকতা ও পীড়িতের বিজয় আবহমানতার আলোকে উদ্ভাষিত করেরবীন্দ্রনাটক আমাকে টানে নিশ্চিত ভাবেই এইসব কারণে ।

সংশপ্তক:   এই যে জীবনের বিভিন্ন পর্যায় আমরা রবীন্দ্রনাথকে নিত্য নতুন নানা ভাবে আবিষ্কার করি, এই বিষয়টি আপনি কি ভাবে ব্যাখ্যা করবেন? আমাদের এই ধারাবাহিক ভাবে রবীন্দ্রমানস আবিস্কার আসলেই রবীন্দ্রনাথেরই সাথে পথ চলা নয় কি? না কি এই আবিস্কারের সাথে আমাদের নিজস্ব ব্যক্তিত্বের আত্মিক যোগ ততটা নেই যতটা মেধা বুদ্ধিবৃত্তির যোগ আছে?
ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়: প্রশ্নটা ঠিকই, আমাদের রবীন্দ্র-অন্বেষণ তো তাঁর সঙ্গেই পথচলাএকটা মাত্র জীবনে সে অন্বেষণ শেষ হবার নয় এটাও সত্য । রবীন্দ্র-অন্বেষণ বা রবীন্দ্রনাথকে নবনব ভাবে আবিস্কার যাই বলিনা কেন তাঁর সঙ্গে পথ চলার পেছনে ব্যক্তির একটা আত্মিক তাগাদা না থাকলে তো সেই পথ চলা নিররর্থক ব্যক্তির মেধা ও বুদ্ধিবৃত্তি তার পথ চলাকে সার্থক করতে পারে মাত্র । আমি মনে করিনা মেধা ও বুদ্ধিবৃত্তিই রবীন্দ্রনাথের সাথে পথচলার একমাত্র সর্ত । বিষয়টা একটু পরিস্কার করি / শম্ভূ মিত্র নাটকের রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে পথ চলেছিলেন আর আপন মেধার মিশ্রণ ঘটিয়ে তাঁর পরিক্রমাকে সার্থক করেছিলেন, আমাদের চিনিয়েছিলেন নাটকের রবীন্দ্রনাথকে । কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, দেবব্রত বিশ্বাসরা গানের রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে পথ চলেছিলেনদেবব্রত বিশ্বাস থেমে গিয়েছিলেন বা তাঁকে থামিয়ে দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু অসামান্য সাঙ্গীতিক মেধা নিয়েও অন্য গানে ফিরে যাননি ১৩ বছর বয়সে বালিকা কণিকাকে ভুল বুঝিয়ে আধুনিক গান রেকর্ড করিয়েছিল রেকর্ড কোম্পানীরবীন্দ্রনাথ দুঃখ পেয়েছিলেন । শান্তিনিকেতনে ফিরে কণিকা সেই রেকর্ড প্রত্যাহার করে নিয়েছিলেন । সেই গান আর প্রকাশিত হয়নি । কণিকাও অন্য কোন গানের আশ্রয় নেননি বিষয়টা হ’ল ‘জিজ্ঞাসা’ অন্তরে জিজ্ঞাসা না থাকলে কি নিয়ে পথ চলবো রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে, কি অন্বেষণ করবো অন্তরের জিজ্ঞাসা না থাকলে ?

সংশপ্তক:   রবীন্দ্রপ্রতিভার কোন দিকটি আপনাকে বেশি করে টানে কেন? বর্তমানে আপনার ব্যক্তিগত জীবন যাপন সংস্কৃতি চর্চার পরিসরে রবীন্দ্রনাথের উপস্থিতির চিত্রটির স্বরূপ বিকাশ সম্বন্ধে যদি কিছু বলেন
ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়:  “জীবন যখন শুকায়ে যায় করুণাধারায় এসো
     সকল মাধুরী লুটায়ে যায় গীতসুধারসে এসো...”
জীবনের শেষ প্রান্তে পৌছে আমাকে বলতেই হবে, গানের রবীন্দ্রনাথই আমাদের শেষ আশ্রয় একথা ঠিক রবীন্দ্রনাথের গানের অন্তর্দীপ্তিতে আকর্ষিত হতে বাঙালির অনেক সময় লেগেছে  রবীন্দ্রনাথ সেকথা জানতেন না তেমন নয় । কিন্তু তিনি স্থির প্রত্যয়ী ছিলেন যে বাঙালিকে তাঁর গান গাইতেই হবে । তিনি বলেছিলেন “বাংলাদেশকে আমার গান গাওয়াবোই । আমি সব যোগান দিয়ে গেলুম ; ফাঁক নেই । আমার গান গাইতেই হবে – সব কিছুতেই” কোথা থেকে তাঁর এই প্রত্যয় ? বাংলা গানের শিকড় সন্ধান করেই তিনি এই নিশ্চিত বিশ্বাস অর্জন করেছিলেন । তিনি বুঝেছিলেন বাঙালি কোন দিনই শাস্ত্রীয় গান বা তার গায়নরীতিকে  আপন করে নেয়নি । তাই কীর্তনের মধ্যেই বাঙালি তার নিজের গান নিজে তৈরি করেছিল । হ্যা, ওস্তাদি গানের সঙ্গে সম্পর্কহীন ‘কীর্তন’ই বাঙ্গালির প্রথম নিজস্ব গান । কীর্তন , রায়গুণাকর ভরত চন্দ্র, রামপ্রসাদ সেন, নিধুবাবু , দাশরথী রায়’এর পাঁচালি গান- বাংলা গানের যে নিজস্ব ধারা , সেই ধারা থেকেই তিনি বাংলা গানের উত্তরণ ঘটালেন আধুনিকতায় । তাঁর হাত ধরেই বাংলাগান আধুনিক হয়ে উঠল কাব্যের লাবণ্য আর সুরের মেল বন্ধনে । বললেন “আমার গানের মধ্যে সঞ্চিত হয়েছে দিনে দিনে সৃষ্টির শেষ রহস্য , ভালোবাসার অমৃত” “গানের সুরে আমার মুক্তি ঊর্ধে ভাসে” এ উচ্চারণ শুধুমাত্র তাঁর গানের একটি কলি মাত্র নয়, আমাদের মনের মুক্তির মহামন্ত্র । তাই তাঁর জন্মের দেড়শ’ বছর পরেও আমাদের সব জিজ্ঞাসা, সব-দুক্ষ-দুঃখ, বিষাদ-বেদনা থেকে উত্তরণের ঠিকানা লেখা আছে গীতবিতান’এর ২২৩২টি গানের মধ্যে । একুশ শতকের এই বৈদ্যুতিন বিশ্বে এখন একজন গ্রামীণ মানুষ তার কানে ভেসে আশা কোন গানকে অনায়াসে সনাক্ত করতে পারেন ‘রবীন্দ্র সঙ্গীত’ বলে । কোথায় এর রহস্য ? কেনই বা রবীন্দ্রনাথ বলতে পেরেছিলেন বাঙালি সুখে দুঃখে তাঁর গানই গাইবে । যে মানুষ রবীন্দ্রনাথের কবিতার একটা পংক্তিও পড়েননি তিনিও কোন রহস্যে রবীন্দ্রগানে অবগাহন করতে পারেন ? পারেন, কারণ ঐ যে রবীন্দ্রনাথই বলেছেন তাঁর গানে সঞ্চিত হয়েছে সৃষ্টির শেষ রহস্য , ভালোবাসার অমৃত ।
রবীন্দ্রনাথের গানে আধুনিকতার যে নির্মিতি তার মূলে  ছিল বাঙালির মনন, তার যাপন সম্পর্কে তার গভীর অন্বেষণ, অধ্যয়ন । বাঙালির ভাষা ও সাহিত্যের শুরুই কাব্যের বাঁধনে । বাঙ্গালি কোনদিনই রাজ দরবারের গানকে আপন করে নেয়নি, সঙ্গীত শাস্ত্রের অনুশাসনও সে মানেনি, জনপদের গানকেই সে চেয়েছে । বাংলার প্রথম নবজাগরণ কালের কীর্তন গান থেকে মধ্যযুগ পেরিয়ে তাঁর সমকালের পাঁচালি গান পর্যন্ত আমরা বাংলা গানের এই একই ধারা দেখি এবং সে গান কাব্য নির্ভরকীর্তন থেকে রামপ্রসাদী, টপ্পা, পাঁচালি গানের সে স্রোত সবেতেই কাব্যের সঙ্গে সুরের মেলবন্ধন, রবীন্দ্রনাথ বাংলা গানে আধুনিকতার নির্মাণ করলেন এই ধারাতেই । ‘আত্ম প্রকাশের জন্যই বাঙালি গানকে অত্যন্ত করে চেয়েছে’ এই সত্য বুঝেছিলেন বলেই তিনি নিজেকে উজাড় করে দিয়েছিলেন বাংলাগানের জন্য ।
দ্রষ্টা রবীন্দ্রনাথ তাঁর সমকালের চেয়ে সহস্র যোজন অগ্রগামী ছিলেন  বলেই নিজের সৃষ্টির প্রতি এমন স্থির বিশ্বাস ব্যক্ত করতে পেরেছিলেন জীবনের উপান্তে এসে “...যুগ বদলায়, তার সবকিছু বদলায় । তবে সবচেয়ে স্থায়ী হবে আমার গান এটা জোর করে বলতে পারি .....যুগে যুগে এ গান তাকে গাইতেই হবে । তাই প্রজন্মের পর প্রজন্ম তাঁর সুরের ধারায় অবগাহন করে চলেছে, এবং জীবনের উপান্তে  গানের রবীন্দ্রনাথই আমার পরম আত্মীয়

সংশপ্তক:   আধুনিক বাঙালির সমাজ জীবনে রবীন্দ্রনাথের অপরিসীম প্রভাব সম্বন্ধে আমরা সবাই ওয়াকিবহাল, তবু তিনি যে সমাজ-ভাবনার দিশা দিয়ে গিয়েছিলেন আমাদের সমাজ আদৌ সেই পথে এগোয়নিতিনি জোর দিয়েছিলেন গ্রামীন অর্থনীতির স্বনির্ভরতার উপরতিনি চেয়েছিলেন ধনতান্ত্রিক অর্থনীতির বিকল্প হিসেবে সমবায় প্রথার বিকাশ সাধনআমরা কবির সমাজ-ভাবনার এই দিকগুলিকে সর্বতোভাবে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করেছিএই বিষয়টিকে আপনি কিভাবে দেখেন?
ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়:  টেলিভিশনে দেখা কোন এক বহুজাতিক কোম্পানীর একটা বিজ্ঞাপনের কথা মনে পড়ে ? একটা দামি মোবাইল সেট কেনার লোভ দেখিয়ে বলছে হাতের মুঠোয় পৃথিবী চলে আসবে । এর পাশে রাখি ‘রক্তকরবী’ নাটকে অধ্যাপক ও নন্দিনীর কথোপকথনের অংশ । অধ্যাপক নন্দিনীকে বলছেন “ আমরা যে মরা ধনের শবসাধনা করিতার প্রেতকে বশ করতে চাই । সোনার তালের তাল-বেতালকে বাঁধতে পারলে পৃথিবীকে পাব মুঠোর মধ্যে” তো আমাদের রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় সোনার তাল-বেতালের শবসাধনার বন্দোবস্তে রবীন্দ্রনাথের স্বনির্ভর অর্থনীতির ভাবনার জলাঞ্জলি হলে কিইবা এলো-গেলো রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রকদের ! থাকুননা কবিগুরু ক্যালেন্ডার হয়ে দেওয়ালে লটকে ! ব্যাপারটা এইরকম আরকি । রবীন্দ্রনাথের স্বনির্ভর গ্রামীণ অর্থনীতির চিন্তা কোন কল্পনা মাত্র ছিলনা, পাতিসরে জমিদারি পরিচালনার দিনগুলিতে হাতে কলমে করে দেখিয়েছিলেনবস্তুত, এদেশে সমবায় ব্যাঙ্কের যে ধারণা তার প্রবর্তক রবীন্দ্রনাথই । রবীন্দ্রনাথের পল্লি-চিন্তার বৈশিষ্ট্য ছিল যে রাজনীতির বাগাড়ম্বর পরিহার করে বাস্তব ও শ্রমসাধ্য পন্থার অনুসরণ করে গ্রামের মুক্তি, কল্পনা করেছিলেন এক ‘স্ববশ’ সমাজের । কিন্তু আমাদের রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রকরা ভেবেছিলেন অন্যরকম । দেশটাকে করে দিলেন ‘উন্মুক্ত বাজার’, আর আমরা সব ভুলে কেমন সোনার তাল-বেতালের শবসাধনায় মেতে ঊঠেছি ! রবিন্দ্রনাথের কাঙ্খিত সেই স্ববশ সমাজের ধারণা লেখা থাকবে কিতাবে আর কিছু বিদগ্ধ মানুষের লেখায়। এ ছাড়া অন্য কোন সংকেত তো পাচ্ছি না আমরা । এখন তো চার অক্ষরের দুটি দানবিক শব্দ নিয়ন্ত্রণ করছে আমাদের চাওয়া-পাওয়া, পাওয়া-না পাওয়া, আমাদের ডুবে যাওয়া-ভেসে থাকা – সবইতবে ভবিষ্যৎ একদিন জবাব চাইবে । চাইবেই ।

সংশপ্তক:  আরও একটি বিষয়কে কবি দ্ব্যার্থহীন ভাবে তুলে ধরেছিলেন, সে হল শিক্ষায় মাতৃভাষার গুরুত্ব! তিনি খুব সুস্পষ্ট করেই বলেছিলেন বারো বছর বয়স অব্দি শিশুদের শুধুমাত্র মাতৃভাষাতেই শিক্ষা দেওয়া উচিৎঅথচ আজকের দুই বাংলায় নার্সারি থেকেই স্বছ্বল পরিবারের শিশুদের ইংরেজী মাধ্যমের স্কুলগুলিতেই ভর্ত্তি করার জন্যে অভিভাবকরা আদাজল খেয়ে উঠে পড়ে লাগেনএই বিষয়ে আপনার অভিমত কি?
ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়: প্রশ্নের মধ্যেই সবটুকু বলা হয়ে গেছে আজকের ছবিটা । ১৮৩৫এ এদেশে ইংরাজি বিদ্যা প্রচলন করার সময় তার প্রবর্তক মেকলে বলেছিলেন “ এখন আমরা আন্তরিক ভাবে একটা শিক্ষিত শ্রেণী তৈরি করতে পারি যারা আমাদের ও আমাদের দ্বারা শাসিতদের মধ্যে দোভাষীর কাজ করবে; এমন একটা শ্রেণী যারা রক্ত ও চেহারায় ভারতীয় কিন্তু রুচি, রীতি-নীতি ও মেধায় ইংরাজ” (‘we must at present do our best to form a class who may be interpreter between us and millions whom we govern; a class of persons, Indian in blood and colour, but English in taste, opinions and intellect’). তো, আমরা তো দেশের শিক্ষানীতিতে মেকলের নীতিরই উত্তরাধিকার বহন করে চলেছি । সেই শিক্ষানীতির মূল কাঠামোর বিশেষ হেরফের তো হয়নি । আর এ কথা এখন আর অজানা নেই যে ‘বিশ্বায়ন’ নামক দানবীয় বন্দোবস্তকে পোক্ত করার  প্রথম কাজ হচ্ছে সেই দেশের ভাষা, সংস্কৃতি ও মূল্যবোধগুলিকে ধীরে ধীরে লোপাট করে দেওয়াত্রিশ বছরে সেই কাজটা তো প্রায় সম্পূর্ণই হয়ে গেছে । এখন শুধুই হাহাকার !
আমি জানি না পণ্যায়নের সর্বপ্লাবী প্রভাবের মাঝেও নবীন প্রজন্মের মননে রবীন্দ্র-আবেগ কতটা আছে বা আদৌ আছে কি না । তেমন কোন আশাবাদী সংকেত আমি অন্তত দেখতে পাচ্ছি না । তবুও আমার বিশ্বাস গানের রবীন্দ্রনাথ বাঙ্গালির হৃদয়ে জাগরুক থাকবেন নিশ্চিত ভাবেই আরো অনেক প্রজন্ম ।
তবুও সংশয়, পরিণত বয়সে রবীন্দ্রনাথ আপন আন্তরিক আকাঙ্খার যে উচ্চারণ করেছিলেন –
“আমার জীবনে লভিয়া জীবন
জাগোরে সকল দেশ”
সে ডাকে কেমনতর সাড়া দেবে আগামী প্রজন্মের পঁচিশে বৈশাখ - জানি না, দেবে কি ?

[ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়: বিশিষ্ট নাট্যব্যক্তিত্ব কবি সাহিত্যিক ও সমাজসেবী]



Comments
0 Comments

No comments:

Blogger Widgets
Powered by Blogger.